এনামুল মবিন(সবুজ),স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশে যতগুলো উৎসব হয় সেগুলোর মধ্যে অন্যতম নবান্ন উৎসব। হেমন্তকালের এই উৎসব ছিল সর্বজনীন। নতুন আমন ধান কাটার পর সেই ধান থেকে প্রস্তুত চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব হচ্ছে নবান্ন, যা সাধারণত অগ্রহায়ণ মাসে আমন ধান পাকার পর অনুষ্ঠিত হয়। বাংলার কৃষিজীবী সমাজে শস্য উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব আচার-অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়, নবান্ন এর মধ্যে অন্যতম।
‘নবান্ন’ শব্দের অর্থ ‘নতুন অন্ন’। নবান্নের নতুন ধানের গন্ধ আজও শরীরে লেগে আছে। যে গন্ধের সঙ্গে মিশে শ্রমজীবী কৃষকের হাসি, কান্না, আনন্দ-বেদনা আর কষ্টের ইতিহাস। কার্তিক আর অগ্রহায়ণ মাস নিয়ে হেমন্ত ঋতু। অগ্রহায়ণের নবান্ন নিয়ে আসে খুশির বার্তা। নতুন ধান ঘরে উঠানোর কাজে ব্যস্ত থাকেন কৃষক এবং তার পরিবার। কিন্তু দিন বদলে কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব।

চিরিরবন্দর উপজেলার বিভিন্ন এলাকার স্থানীয়রা জানান, সময়ের পরিবর্তন হওয়ায় এ জনপদের সংস্কৃতি পাল্টে যাচ্ছে। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী উৎসব নবান্ন। গ্রামীণ জনপদে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ থাকলেও কৃষকের ঘরে ঘরে নেই নবান্নের আমেজ। ঘরে ঘরে নেই নতুন চালের ক্ষির, পিঠাপুলি আর ফিরনি পায়েসের উৎসব। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব যেন দিনদিন কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। সিকি শতাব্দী আগেও হেমন্তের ধান কাটা-মাড়াইয়ের মধ্যদিয়ে নবান্নের উৎসবে মুখরিত হতো গ্রামের প্রতিটি আঙিনা। অথচ আধুনিকতার ছোঁয়ায় এ জনপদের জনজীবনে নবান্ন উৎসব এখন অনেকটাই স্মৃতি। আর নতুন প্রজম্মের নিকট নবান্ন যেন দূরের শোনা গল্পের মতো।
শিক্ষক মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে সবকিছুর। হেমন্তের ধান কাটা শুরু হলেই মনে ভেসে ওঠে নবান্ন উৎসবের আমেজ। প্রাচীনকাল থেকেই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নবান্নকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতি উৎসবে মেতে উঠতো। একে অন্যের মধ্যে সৃষ্টি হতো সামাজিক সুসম্পর্ক, সম্প্রীতি আর ভালোবাসা। এখনকার ছেলে-মেয়েরা শুধু নামেই জানে নবান্ন উৎসব। নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ইচ্ছাশক্তি, শখ, আনন্দ-ফুর্তি সবই যেন হ্রাস পাচ্ছে। এসব নানা কারণে সময়ের ব্যবধানে ঐতিহ্য বহন করা নবান্ন উৎসব যেন জনজীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। তাই বাঙালির নানান ঐতিহ্য ধরে রাখতে সমাজের সকল শ্রেণিপেশার মানুষের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আগের মতো করে প্রতিটি ঘরে ঘরে ফিরে আসুক নবান্ন উৎসব, ফিরে আসুক মানুষের মমতার বন্ধন।
উপজেলার বড় হাসিমপুর গ্রামের শিক্ষিকা আফিয়া ফারজানা শিউলি বলেন, আসলে এখন পারিবারিক বন্ধনটা আর আগের মতো নেই। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের প্রতি আত্মিক টান কমে যাচ্ছে। এর প্রভাব পড়ছে সংস্কৃতিতে। পিঠা-পুলি খাওয়ার ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। সংস্কৃতি পাল্টে যাওয়ার কারণে এখন আর নবান্ন উৎসব আগের মতো দেখা যায় না। নবান্নের উৎসব এখন মেকি আনুষ্ঠানিতকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়নের কৃষক মোহাম্মদ আলী বলেন, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমরা দল বেঁধে সবাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে খেয়ে বেড়াতাম। কিন্তু এখন আর সেটা দেখা যায় না। নবান্ন উৎসব আর আগের মতো হয় না। যে যার মতো করে নবান্ন উৎসব পালন করে থাকেন।
উপজেলার আলোকডিহি ইউপির গ্রীনল্যান্ড ব্লগ এন্ড টাইলস ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান এম রফিকুল ইসলাম(রফিক) বলেন, এক সময় এ জনপদে হেমন্ত এলেই নতুন ধান ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত থাকতো কৃষাণ-কৃষাণীরা। ধান ঘরে উঠলে পিঠা-পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যেত। পাড়ায় পাড়ায় চলতো নবান্ন উৎসব। আমি ছোট থাকতে নবান্ন উৎসবকে ঘিরে অনেক আনন্দ করেছি। এখন আর সেই আনন্দ পাওয়া যায় না। আধুনিক সময়ে এসে অনেকেই ছেড়ে দিয়েছেন গৃহস্থালির কাজ। যার ফলে নবান্ন উৎসবও দিনদিন বিলীন হতে চলেছে। প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলের মানুষ ধর্ম-বর্ণ উপেক্ষা করে নবান্নকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে উঠতো। একে অন্যে গড়ে তুলত সামাজিক সম্পর্ক। আজ তা আর তেমন চোখেই পড়ে না।
চিরিরবন্দর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ জোহরা সুলতানা বলেন, কৃষকরা তাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য হিসেবে আমন ধান কাটার পর নতুন ধানের পায়েস ও পিঠা-পুলি তৈরির মাধ্যমে নবান্ন উৎসব পালন করে থাকে। নবান্ন মানে নতুন অন্ন। নবান্নের ফসল আমন কাটা ও ঘরে তোলার আনন্দের পাশাপাশি ধান সংরক্ষণের বিষয়টি উঠে আসে। ঠিকমতো আমন সংরক্ষণ করা না গেলে কৃষক পরিবারের নবান্নের আনন্দ ফিকে হয়ে যেতে পারে। আমনের মাঠে শতকরা ৮০ ভাগ পেকে গেলে ফসল কেটে মাঠে বা উঠানে এনে মাড়াই করতে হয়।
সবুজ/সোহেল/আজাদ/ডেক্স